সেদিন পত্রিকা অফিসে কয়েকজন মেধাবী বন্ধু মিলে রসালাপ করছিলাম। প্রেম, বিয়ে, দাম্পত্য, বিদেশী ডিগ্রি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাকার বিভিন্ন প্রসঙ্গের পর অবশেষে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালো “ভাগ্য”। কে ভাগ্যবান আর কে ভাগ্যহীন, এ নিয়ে আলোচনা অবশেষে রূপ নিল সমালোচনা আর বিতর্কে। বিতর্কের অবতারণার এক পর্যায়ে জনৈক সুহৃদ আমার প্রসঙ্গের ওপর জোর দিতে চাইলে সবাই মিলে একযোগে স্বীকৃতি দিল যে, তাদের চেয়ে আমি বেশি ভাগ্যবান এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাদের প্রশংসায় আমিও কিঞ্চিত পুলকিত বোধ করি।
কিন্তু কথা হলো- আসলে কি আমি আদৌ ভাগ্যবান? এ বিষয়টার ওপর গুরুত্ব দিয়ে যখনই আমি ভাবতে শুরু করি, মনে পড়ে যায় প্রায় এক যুগ পূর্বের কিছু কথা। তখন আমি লক্ষ্মীপুর কলেজের ছাত্র; রিডিং রুমে ইত্তেফাকের উপ-সম্পাদকীয় কলাম “সন্ধানী” পড়ছিলাম এবং সেখানে প্রাসঙ্গিক বিষয়টা অর্থাৎ ভাগ্যের ব্যাপারে আমি যে কথাগুলো টুকে নিয়েছিলাম সেগুলো ছিল এরূপ, ‘ভাগ্যবানরা নিম্নোক্ত কাজগুলো করে, যেগুলো ভাগ্যহীনরা করে না বলে দুর্ভাগাদের গোটা জীবনটাই দুঃখ-দুর্দশার ভেতর দিয়ে কাটে। (১) বন্ধুত্ব বা যোগাযোগের প্রসারতা (২) সমস্যা মোকাবেলায় প্রস্তুতি (৩) ঝুঁকি প্রবণতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন (৪) সাহসিকতা এবং (৫) ক্ষতির পরিমাণ লঘুকরণ। এভাবে টুকে নেয়াটা আমার অভ্যাস। নইলে বেশিদিন মনে থাকে না। এ ব্যাপারে শ্রদ্ধেয়ভাজন আবদুর রব চৌধুরী (সিএসপি) সর্বদাই পরামর্শ দিয়ে থাকেন, মাথায় যাদের কিছুই নেই তাদের টোকা ছাড়া উপায় কি? অবশ্য এই অভ্যাসের সুবাদেই হয়তো আজকে উপরোক্তটুকুন উদ্ধৃত করতে সক্ষম হয়েছি।
যাই হোক, আসল কথা হলো সন্ধানীর ঐ কথাগুলো তখন যুক্তির সাথে মিলিয়ে নিয়ে আমি অনুশীলন করতে চেষ্টা করি এবং আজকাল শুধু অনুশীলনই নয় প্রয়োগ করতেও চেষ্টা করছি। প্রয়োগে কোন ত্রুটি না থাকলে ফলাফল নিশ্চয়ই শুভ। কিন্তু তা কতটুকুন সেটাই পরিমাপ্য।
সন্ধানীর উক্ত কথাগুলোর প্রথমটির অনুশীলন এবং প্রয়োগে আমি যা বুঝতে পেরেছি, তা হলো- মানুষই সর্বাপেক্ষা দুর্বোধ্য প্রাণী। মানুষের মধ্যে যারা আবার অশিক্ষিত তারাই বেশি পরিমাণে দুর্বোধ্য। অথচ আমি শিক্ষিত-প্রভাবশালী লোকদের সংষ্পর্শেই বেশি থাকছি এবং তাঁরাও অধিকাংশ সময়েই আমার নিকট দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেন। এখন কথা হলো- কেন এই দুর্বোধ্যতার অপপ্রয়াস। অবশ্য বয়োবৃদ্ধের মুখ থেকে মাঝে মাঝে শুনে থাকি দিন দিন মানুষের মধ্যে নাকি দুর্বোধ্যতা বাড়ছে, পূর্বে এর বালাই কম ছিল। তাহলে এটা কি শেক্সপীয়ার’র ধারণার বাস্তব রূপায়ন যে “A time will come, when the learned shall lament over thier learning, the wise shall wipe over thier wisdom and the fools shall run administration and pass impracticable orders.”
শেক্সপীয়ার-এর কথাগুলোর প্রতিফলন আজকের এই আর্থ-সামাজিক অবস্থা। আর তাইতো-
কোথাও নিয়ম নেই আজ
প্রকৃতিও অনিয়ম মেনে চলে আজকাল,
অসুস্থ প্রকৃতি দারুণভাবে বিবর্ণ আজ
আমরা সবাই তার যন্ত্রনার শিকার ॥
তবুও আমি অনিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে নিয়মতান্ত্রিকতাকে উপলব্ধি করতে সদা মত্ত। সমাজের জন্য কিছু করতে না পারি কিছুটা বুঝতে চেষ্টা করছি। সে লক্ষ্যেই আমি স্থান থেকে স্থানান্তরে আর মন থেকে মন্নন্তরে ঘুরপাক খাচ্ছি। মেধা সন্ধানী উইলিয়াম বাটলারের নেশা ছিল সৃজনী শক্তি সম্পন্ন লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। বন্ধুগণ বিশেষভাবে ড. মাহমুদ আহমেদ যিনি এখন বিআইবিএম-এর ফ্যাকাল্টি মেম্বার, তিনি প্রায়ই আমার ব্যাপারে রসিকতা করে বলে থাকেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শুরু করে সচিবালয়, মতিঝিল হয়ে প্রধান বিচারপতির বাস-ভবন পর্যন্ত যার পদচারনণা ছাত্রবয়সেই লক্ষ্য করা যেত, তার...”।
আরে, আলোচনার মূল বিষয় থেকে ছিটকে পড়ছি যে! ভাগ্য নিয়ে কথা হচ্ছিল, তা নিয়েই আলোচনা করি, দেখি ভাগ্য কত দূর। ভাগ্য বলতে কিছু আছে কিনা জানি না। তবে আমি মনে করি, মানুষের জীবনে যা কিছু রটে, যা কিছু ঘটে, তার সবই কর্মফল। ডাঃ লুৎফর রহমান বলেছেন, “যারা কাপুরুষ-তারাই কপালের দিকে তাকায়, পুরুষ তাকায় তার বাহুর দিকে। তোমার কপাল তোমাকে টেনে তুলবে না তোমার বাহু তোমাকে টেনে তুলবে”।
ভাগ্যহীনদের ধারনা “আল্লাহ যখন দেয়, ছাপ্পড় ফাইরা দেয়” কিন্তু আল্লাহ ছাপ্পর ফেরে কাউকে কিছু দেন না। তিনি মানুষকে যে মেধাশক্তি দিয়েছেন, তা দিয়েই মানুষের ভাগ্য উন্নত করতে হয়। ক্রোড়পতি তেল ব্যবসায়ী জে পল গেটি বলেছেন, “সবটাই সুযোগের সদ্ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু না কিছু সুযোগ আসে। ঠিক সময়ে যদি সাহসিকতার সঙ্গে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়, ভাগ্য তখন না হেসে পারে না”।
জনৈক সুপ্রতিষ্ঠিত ক্রোড়পতি সুইস ব্যাংকার বলেছেন, “ভাগ্যের দড়ি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দড়ি ছিড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগেই অন্য দড়ির সন্ধান কর, কারণ ভাগ্যের দড়ি একটি নয়, বহু। চিনে নিতে পারলেই হয়”।
তাই আমারও কথা- জীবনে শেষ কথা বলে কিছু নেই, শেষ পথ বলে কোন পথ নেই। পথ অনন্ত। সেই পথ চিনে নেয়ার জন্য প্রয়োজন পরিচয়ের দিগন্ত প্রসারিত করা। পরিচয়ের দিগন্তও আবার খুব সহজেই উন্মোচিত হয় না। তজ্জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় বৈষয়িক ভিত্তি। এ ভিত্তিটা অর্জিত হতে পারে শুধুমাত্র কর্মোদ্যম আর কর্ম-প্রচেষ্টা দ্বারা। এ প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি বিভিন্ন দিক থেকে লাভবান হতে পারে। যেমন- অর্থ, অভিজ্ঞতা, পরিচিতি, সুখ্যাতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এক কথায়, কাজ করে এবং কাজের দ্বারাই জীবনের অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হয়। যে জীবনে কাজ নেই- সে জীবনে আর কিছু দিক থাকলেও অগ্রগতি থাকতে পারে না। এ জন্যই রঁমা রোলা বলেছেন, ‘জীবনে যদি অগ্রগতি না থাকে, তবে সে জীবন অবাঞ্ছিত’।
অনেক সময়ে তথাকথিত ভাগ্যবান বন্ধুমহলেও লক্ষ্য করি যে, তাদের বাবার প্রচুর অর্থ-সম্পদ বা সামাজিক প্রতিপত্তি রয়েছে বলে তারা আর কাজ করতে নারাজ, এমনকি যে শিক্ষা ছাড়া আত্মোন্নতি অসম্ভব সে শিক্ষায়ও তাদের বিমুখতা লক্ষ্য করা যায়। তারা লজ্জাহীনভাবে বলে থাকে ‘অত- দিয়ে কি হবে’। অথচ একটিবার বিবেচনা করে না যে, অত কিছু শুধু তার বাবারই, তার হতে পারে না। আর বাবার বর্তমানে এবং অবর্তমানে বাবার পরিচিতি দিয়েই তাকে পরিচিত হতে হবে। অর্থাৎ সে অমুকের ছেলে, তমুকের ভাগিনা এবং অমুকের রেখে যাওয়া তমুক সম্পত্তি বা ইন্ডাস্ট্রির উত্তরসূরী অথবা বর্তমান মালিক। একটি উদাহরণ দিয়ে আরেকটু গভীরে যাই-
মি. বিগ চৌধুরী তার চল্লিশ বছর বয়সে বাবা মি. এল চৌধুরীর মৃত্যুর পর “এল চৌঃ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ” এর মালিক এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলেন। অন্যদিকে তার ছোটবেলাকার অবহেলিত (বিত্তহীন বলে) অথচ কঠোর পরিশ্রমী বন্ধু মি. লিটল চেপ একই বয়সে পৌঁছে “লিটল চেপ ইন্ডাস্ট্রী’ নামে নিজেই একটা কারখানা দিতে এবং এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হতে সক্ষম হলেন, এখানে ক্ষমতার এবং বিত্তের দিক থেকে বিগ চৌধুরী বড় হলেও লিটল চেপ অবশ্যই অধিক গৌরবের অধিকারী, কারণ তার বিত্তের চেয়ে চিত্তের দৃঢ়তা অধিক এবং তাই তার জীবনে অগ্রগতিও বেশি। মোট কথা একজন শুন্যের কোটা থেকে শুরু করে দশের কোটায় পৌঁছলে এবং অপরজন দশের কোটা থেকে শুরু করে বিশ এর কোটায় পৌঁছলে এবং প্রত্যেকের গতির মোট পরিমাণ দশ হলেও প্রথমজন অগ্রগতির গতিশীলতায় বেশি এবং তার জীবনে অভিজ্ঞতা, গৌরব ও পরিতৃপ্তি বেশি বলে সে-ই অধিক ভাগ্যবান হবার কথা।
কিন্তু বাস্তবে আমরা কি করছি। কে কত বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক বা কত বড় কর্মকর্তা, আর কে ধানমন্ডি বা বনানীর কোন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ির মালিক, কে কত বড় চেয়ারে বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন, তার/তাদের প্রতিই আমরা গতানুগতিকভাবে বেশি মুগ্ধ হই, শ্রদ্ধায় মাথা নত করি। অথচ তাদের মধ্যে কার জীবনের উৎপত্তি বা শুরুটা কোথায়, অগ্রগতি কতটুকুন- সেদিকটা আমাদের বিবেচনায় আদৌ স্থান পায় কি? আর এ জন্যই সম্ভবতঃ আমাদের সমাজে অগ্রগতিও কম। সমাজের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি জীবনের অগ্রগতির পরিমাপ নয় বরং ভাগ্যবানদেরকেই ভাগ্যবান বলে প্রশংসিত করা। তবেই ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ভাগ্যদেবীর সুপ্রসন্নতার পরিলক্ষণ অবশ্যম্ভাবী হতে পারে। কবে হবে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সেই সময়টাকে স্বাগত জানাচ্ছি মনে-প্রাণে, ব্যপ্তিতে-সুপ্তিতে।
(১৯৯৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার অক্টোবর সংখ্যায় মুদ্রিত)