মহামারী—দুর্যোগসহ যেকোন প্রতিকূলতা জয়ের মাধ্যমে
জীবনমানের বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটাবেন যেভাবে
গত দু’বছর থেকে বিশ্বব্যাপী চলছে কভিড—১৯ তথা করোনা মহামারীর দোর্দন্ড প্রতাপ বা মহাপ্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। এটিকে কেউ দেখছেন মহাকালের মহাবিভীষিকা হিসেবে, আবার আমার মতো কেউ কেউ দেখছেন পুরো পৃথিবী মেরামতের আশীর্বাদ হিসেবে। লক্ষ মানুষের মৃত্যু—ক্ষতির কারণ বাদ দিলে আর বাকি হাজার কোটি মানুষের চিন্তা ও মননের পরিবর্তনে এ অদৃশ্য—অস্পৃশ্য ক্ষুদ্র করোনা—শক্তি বা Corona God এর আবির্ভাবের যে দরকার ছিল, তা বিজ্ঞানীরাও মনে করছেন। বিশ্ব—দৃশ্যের ও মনুষ্য—চরিত্রের চেহারা পাল্টানোয় করোনা—গড এর আবির্ভাব ও পরিবর্তন এবং এরূপ জরুরি লকডাউন ও শাটডাউন অবস্থা ছিল অপরিহার্য।
সব মিলিয়ে এটি একটি মহাপ্রতিকূল পরিবেশ। সবাই লাগাতার লকডাউন—শাটডাউনে সুদীর্ঘ গৃহবন্দী; সবার মুখে ঠুসি—মাস্ক, সবাই বাকরুদ্ধ, কথা বন্ধ; বার বার শুধু ধৌতকর্মে ও পরিষ্কার—পরিচ্ছন্নে ব্যস্ত—তটস্থ। এ পরিস্থিতিতে পড়ে অনেক শুভানুধ্যায়ী বিভিন্ন প্রশ্ন করেন, পরামর্শ চানÑ কী করবেন? কী করা যায়?
করোনা মহাদুর্যোগের এ পরিস্থিতি যেহেতু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তাই এর সাথে সমঞ্জস (Match & Adjust) করে সাধারণদেরকে টিকে থাকতে হবে কঠোর মিতব্যয়িতার মাধ্যমে, এমনকি জীবনমান কমিয়ে হলেও। অন্যদিকে এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অধিক গতিশীল এবং শক্তিমান হবারও সুযোগ রয়েছে বিশেষ প্রতিভাবানদের। তা কীভাবে? সে ক্যারিশমেটিক প্রসঙ্গসমূহে যাবার আগে প্রতিকূলতায় পজিটিভ ও নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিছু কথা বলছি।
আমাদের জীবনের মালিক হচ্ছেন স্রষ্টা, আর জীবন—সৌন্দর্যের মালিক হচ্ছি আমরা। আমাদের জীবন স্রষ্টার কাছে হলেও সুউন্নত জীবন হচ্ছে নিজের কাছে। কারণ মহান স্রষ্টা অনুগ্রহ করে আমাদেরকে যে জীবন দেন, সেই জীবনকে বহুমুখী কলাকৌশলে সুন্দর—সফল ও গুরুত্ববহ করে তোলার কাজগুলো নিজকেই করতে হয়; এ দায়িত্ব অন্য কারুর নয়। ‘আমার বাবা গরিব, আমার জন্মের পর মা মারা যায়, বাবা আমাদেরকে ফেলে রেখে চলে গেছে, বাড়ির কাছে স্কুল ছিল না, আমি অমুক অমুক কিংবা ঐ ঐ সুযোগটি পাইনি; এরূপ অনুযোগ—অযুহাত মিথ্যে আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ এরূপ অসুবিধায় থাকাদের বহুজনই ইতোমধ্যে দেখিয়ে দিয়েছেনÑ কেউ পাশে না থাকলেও, কেউ কিছু না দিলেও নিজ কর্মযোগী দু’হাত আর ক্ষমতাধর মস্তিষ্ক দিয়ে স—ব কিছুই করা যায় এবং তা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোদের চেয়েও ঢের বেশি বড়। তাতে বহুগুণ সাফল্য, মহাগুণ আত্মশক্তি, আত্মতৃপ্তি এবং তা অন্যের কাছে অধিক অনুকরণীয়, স্মরণীয়—বরণীয়।
তাইতো উচ্চকন্ঠে আমি বলতে চাই- প্রতিকূলতা হচ্ছে দুর্বল চিত্তের তথা Negative Mind এর আক্ষেপী বিলাপ, অযুহাত—অনুযোগ—অভিযোগের মিথ্যে আত্মপ্রসাদ। অন্যদিকে এই প্রতিকূলতাই আবার সবল চিত্তের তথা Positive Mind এর অহংকার, স্বগর্জনে জেগে উঠার এলার্ম, দৃপ্ত শপথের স্বদর্প পদচারণা; এটি মহাজয়, বিশ্বজয় ও সর্বজয়ের নেশার নেপথ্য শাণিত শক্তি!
প্রতিকূল পরিস্থিতি! এ বিষয়টি সৃজনশীলদের জন্যে দারুণ মজার খেলা; আবার সাধারণ কিংবা অথর্বদের জন্য মহাসংকট ও মহাদুর্যোগের ঘনঘটা। যার যেরূপ দৃষ্টিভঙ্গি (Belief System), তিনিতো সেভাবেই নেবেন। পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ প্রতিকূলতার সাথে সমঞ্জস খেলার আসর বসিয়ে বাসর সাজান, স্বর্গসুখ লাভ করেন। আবার নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ প্রতিকূলতার কাছে অবলীলায় হেরে গিয়ে নরকের বাসিন্দা হয়ে দুর্দশা ভোগ করতে থাকে।
Positive Thinker always have solution for every problem. অর্থাৎ জীবন চলার পথে যেকোনো সমস্যার সমাধানে তথা জীবন—সাফল্যের জন্যে অনুকূল বা প্রতিকূল পরিস্থিতির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার পজিটিভ বা নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ তার নিজস্ব Belief System; যে বিষয়ে আমার লেখা ‘সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি এবং সাফল্যের শীর্ষ পথে’ বইয়ে “নিজের চিন্তাশক্তি দিয়েই জীবন বদলে দিন, কী কারণে মানুষ ভালো বা মন্দ চিন্তা করে” আর্টিকেলে স্ববিস্তারিত লিখেছি (http://www.helal.net.bd/bangla/book5.php)
এবারে আসি প্রতিকূলতায় টিকে থাকা, জয় করা এবং প্রতিকূলতায় অধিক সফল ও লাভবান হওয়া যায় কীভাবে Ñসে প্রসঙ্গে। এরূপ বহুবিধ সমস্যার একক সমাধানকল্পে আমার ব্যক্তিগত বাস্তব অভিজ্ঞতার কিছু গল্প বলছি।
প্রথমে করোনা মহামারীর প্রতিকূলতা প্রসঙ্গেঃ
করোনা মহামারী বাংলাদেশে আঘাত হানে ২০২০ সালের মার্চে। যার ফলে সরকার লকডাউন ঘোষণা করে ২৬ মার্চ থেকে। আমার একটা ছোট্ট অফিস আছে। তাই এরূপ পরিস্থিতিতে ২১ মার্চ অফিস—সহকর্মীগণের স্বশরীরে শেষ উপস্থিতির জরুরি সভা আহ্বান করি। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিভিন্ন কমন বিষয়ে কথা বলার পর গুরুত্বসহকারে আলোচনা করি লাগাতার অফিস বন্ধে নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যচর্চা, খাবার, ঔষধ—পথ্য সংগ্রহ, কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হয়েই যাই —তাহলে সেক্ষেত্রে কী কী করণীয়; লকডাউন বা শাটডাউনে অফিসে অনুপস্থিতিজনিত কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও বাসায় বসে কীরূপ কাজ কীভাবে করা যায় —এরূপ বিভিন্ন প্রসঙ্গে। তবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিলÑ কারুর আয়—রোজগারের পথ যেন রুদ্ধ না করা, এমনকি সংকুচিতও না করা; বরং বিশেষ কর্মযোগী বুদ্ধিমানগণ কর্তৃক বেতন ও আয় কীভাবে বাড়ানো যায়। এরূপ বিভিন্ন দিক—নির্দেশনা দিয়েছি এবং অতপর সবার সাথে নিয়মিত অনলাইন মিটিংয়ের ব্যবস্থা করেছি।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী লকডাউন শুরু হয়ে গেল। সবাই অফিস বন্ধন ছেড়ে শহরের বাসায় কিংবা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। স্বাধীনতা আর আরাম—আয়েশে ফিরে গিয়ে অধিকাংশজনই এতই নিঝুম ও শ্রান্তির ইবলিশী দোলায় দুলে গেছে, তাদের পরবর্তী মাসের বেতন যে তৎপরবর্তী মাসে প্রদেয় হবে না কিংবা কাজ না করার সংগতকারণে বেতন হ্রাস পাবে এবং তারও পরবর্তী মাসে যে বাজার খরচ জুটবে না, বাসা ভাড়া দিতে সমস্যা হবে, শেষতক চাকরি যাবে, অন্যত্র চাকরি যোগাড় কঠিন হবে... এই স—ব কথা বেমালুম ভুলে গেছে বেশ কয়েকজনই। কোনোভাবেই তাদেরকে অনলাইন মিটিংয়ে নিয়মিত করা গেল না। লাগাতার লকডাউনে কয়েকজনেরই লাগাতার ছুটি এবং অবশেষে চির ছুটি।
আবার বেশ কয়েকজন কিছু অনলাইন মিটিংয়ে এবং কিছু মিছু কাজে কিছুদিন লেগে থেকে তারপর বাসা—বাড়িতে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমে এবং করোনা ভাইরাস আক্রান্তের ভীতিতে সন্ত্রস্ত ও হতাশায় উধাও। হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন এখনো টিকে আছে, এমনকি তাদের কেউ কেউ বাড়িয়ে দিয়েছে কাজের সময়ও। সৃজনশীল ও গবেষণামূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডে সোচ্চার সারাক্ষণ আমার সাথে...। এরা প্রমাণ করে দিয়েছে মহামারীতেও আমরা পারি, আমরা বিজয়ী হব, থাকব দিগ্বিজয়ীদের দলে।
এরা ২ বছর আগে তথা করোনা শুরুর আগে যতনা দক্ষ ছিল, যতনা কাজের পাজী ছিল, যতনা কর্মব্যস্ত ছিল; এখন তার চেয়েও ঢের বেশি সুদক্ষ, ঢের বেশি কাজের কাজী, কর্মচঞ্চল ও কর্মযোগী। এদের একজন আছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর আমার অফিসে যোগদান করে কয়েক বছর থেকে অফিসে কম্পিউটারে ধীর কাজের ফাঁকে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে যেতেন; অথচ এখন করোনা শাটডাউনে পড়ে ঐ বয়সী ব্যক্তিই জেগে উঠে কাজে জেঁকে বসেছেন। তিনি তার গ্রামের বাড়িতে থেকে প্রতিদিন আমার সাথে দিবানিশি ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সহযোগী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রতিদিন ১০/১২ পৃষ্ঠা টাইপ—এডিট করে নিয়মিত পাঠান আমার কাছে কিংবা অন্য সিনিয়রের কাছে। তার এরূপ গতিশীলতা লক্ষ্য করে একটা অনলাইন মিটিংয়ে সবার উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞেস করিÑ আপনি এত দ্রুত টাইপ—ম্যাটার আমাকে যে পাঠান, গ্রামের বাড়িতে আপনি কী কনফিগারেশনের ডেক্সটপ বা ল্যাপটপ কম্পিউটার ব্যবহার করেন? উত্তরে বললেন- স্যার, আমি এখন আমার ছোট্ট ফোনসেটেই টাইপ করে আপনাকে ম্যাটার পাঠাচ্ছি। তার এরূপ অবিশ্বাস্য আশ্চর্যজনক কথা শুনে সাথে সাথে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললামÑ ফোনসেটে এরূপ বাংলা টাইপ আমিতো আপনার পাঁচ ভাগের একভাগও পারব না। আপনিতো আমার চেয়েও অনেক বেশি দক্ষ। আপনার কাছ থেকে আমরা সবাই এই স্মার্টনেস শিখব।
বয়ষ্ক ঐ স্টাফের প্রতি প্রশংসা—প্রেরণা দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়ে মিটিং শেষ করে দিয়ে আমি একা একা ভাবলাম- করোনা মহামারী অনুর্দ্ধ ১% মানুষকে জীবনে মেরেছে, কমপক্ষে ৭০% মানুষকে অলস ও কর্মে অক্ষম করেছে, আবার এই বয়ষ্কসহ অন্তত শতকরা ৮/১০ জনকে তো পূর্বের চেয়ে কত বেশি উজ্জীবিত ও কর্মযোগী করেছে; আবার হাজারে ১ জনকে বিত্তবান বানিয়েছে সৎকর্মে উজ্জ্বীবিত করে; তার বিপরীতে আবার লাখে ১ জনকে ধনবান বানিয়েছে অসৎ কর্মে প্রলুব্ধ করে। এর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই স্রষ্টার ভূমিকার পাশাপাশি নিজের ভূমিকা যে কত বড়, তা যদি আমরা সবাই বুঝতাম এবং সংকল্পে দৃঢ় হয়ে ইবলিশের বিরুদ্ধে স্রষ্টার কৃপা—পথের বলীয়ান পথিক হতাম Ñতাহলে হতাম না কেউই আহাম্মক, হতাম না কেউই কর্মহারা। তবে আমাদের অফিস মিটিংয়ে ঐ ব্রিফিংয়ের একটি ফল ভালোভাবে পেয়েছিÑ স্রষ্টার কৃপায় আমার কলিগদের সবাই এখনো পর্যন্ত জীবিত আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
এবারে আসি আরেকটি গল্পেঃ
এই আজই সন্ধ্যায় জগিং মেশিনে ব্যায়াম করছিলাম, তখন ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে দেখলাম ‘মোখলেছুর রহমান পাটওয়ারী’। তিনি আমার প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব; সরকারের সদ্য—অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব। তথ্য—প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক জনসেবার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী সুদক্ষ ও বিরল প্রতিভাদীপ্ত ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভক্ত হিসেবে মেশিনের ওপরে থেকেও তখনি ফোন ধরলাম। সেই বরাবরের মতো সদালাপী ও বন্ধুবৎসল ভঙ্গিতে খুবই খোলামনে তিনি বললেনÑ হেলাল ভাই, আপনিতো শিক্ষা ও সংবাদ নিয়ে কাজ করেন। শিক্ষাঙ্গন বছরের পর বছর বন্ধ হয়ে থাকার কারণে বাচ্চাদের শিক্ষাও প্রায় বন্ধ। ফোনের সাথে তাদের মিতালী দিন দিনই বেড়ে যাচ্ছে। কী হবে এদের বলুনতো?
বললাম, এটিতো আপনার একার সমস্যা নয়, বহু অভিভাবকই এ সমস্যাবোধ করছেন। শিক্ষাঙ্গন খোলার কাজটি আপনার বা আমার এমনকি সরকারেরও ক্ষমতার মধ্যে নেই। এটি করোনার হাতে, আল্লাহর হাতে। আমি যাকে বলি ‘করোনা গড’ এর হাতে। কিন্তু শিক্ষা ও জ্ঞানের কাজগুলোতো অনেকটাই আমার—আপনার হাতেই আছে। অবাক হয়ে তিনি জানতে চাইলেন- কীভাবে? বললাম- এসময়ে তাদের ঘুম—খাবার—দাবারে সর্বোচ্চ ১০/১১ ঘন্টা বাজেটে রেখে বাকি সময়ের ১ ঘন্টা চলমান ক্লাসের সিলেবাস বা কোর্স কারিকুলাম এবং আগামী ক্লাসের সিলেবাস বা কোর্স কালিকুলাম ফলো করানোর জন্যে ব্যয় করানো যায়। এছাড়া ১০ ঘন্টা তারা উদ্দীপনামূলক বই, মণীষীদের জীবনী, বিভিন্ন ইতিহাস, সাইকোলজি, ফিলসফি ইত্যাকার বহু মজাদার—গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবনের অপরিহার্যপূর্ণ পড়ার মধ্যে ডুবে থাকতে পারে; ডায়রী, নোটবুক লিখে ভরে ফেলতে পারে, পত্র—পত্রিকায় লেখালেখি করতে পারে। অন্তত ২/৩ ঘন্টা আপনার সাথে একত্রে ব্যায়াম, মেডিটেশন, ইয়োগা, জামাতে নামাজ, জেকের, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাকার চমৎকার গঠনমূলক কার্যক্রম করার বিরাট সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এই করোনা লাগাতার লকডাউন—শাটডাউন। এ বৈরী প্রতিকূলতার মধ্যে যে ছাত্র—তরুণ যত বেশি এরূপ গঠনমূলক কার্যক্রমের আনন্দে বিভোর থাকবে, সেইতো অন্যদের তুলনায় আগামীর সুউন্নত বিশেষ মানুষরূপে প্রতিষ্ঠা পাবে। তার সাফল্যের এ পথ রুখবে কে, কী দিয়ে?
আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না, এরূপ প্রতিকূলতার মধ্যেই অনেক বড় বড় সৃষ্টি হয়েছে বহু মানুষের দ্বারা, এমনকি শিশুদের দ্বারাও।
বিশ্বনন্দিত বই ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়রী’ এর অমর সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু বর্তমানের করোনা দুর্যোগকালের চেয়েও অধিক মহাসংকটকালে তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও ঐ ছোট্ট শিশু বালিকা যেই গঠনমূলক কিংবা সৃজনশীল কাজটি করেছে, তার বিশ্বনন্দনে সাড়া দিয়ে আমি এ ক্ষুদ্র মানুষটিও তার আমস্টারডামস্থ সেই বাড়ি হন্যে হয়ে দেখতে গিয়েছি।
অনুকূল পরিবেশেতো সবাই কমবেশি পারে, কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে যিনি যত বেশি পারদর্শীতা দেখাতে পারেন -সেই পারদর্শী সাফল্যই তাকে কালান্তরে তত বেশি শ্রেষ্ঠ করে তোলে।
আপনার সন্তানরা যে সেরূপ মেধাবী নয় কিংবা ঐরূপ অমর সৃষ্টি তৈরি করতে পারবে না এ সংকটকালে, তাতো আপনি এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। আজ থেকেই এখনই শুরু করে দিন; তাদের সাথে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়রীর অমরত্বের কাহিনী কিংবা এরূপ Inspiring সত্যি গল্পগুলো শেয়ার করুন। আমার একাউন্টিংয়ের অংক বলে দেয় যে, বাচ্চাদের ব্যাপারে এত কনসার্ন এই আপনিই সরকারের সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদার চেয়েও ঢের বেশি সাফল্যের অমরত্ব পেয়ে যেতে পারেন আপনার এই এখনকার ফোনটিপা বাচ্চাদের মাধ্যমেই।
বললেনÑ বাচ্চাদেরটাতো বুঝলাম, কিন্তু আমি নিজেওতো কর্মহীন থেকে যাচ্ছি। বললামÑ কীভাবে আপনি কর্মহীন! আপনার ঘুম—খাবার—ইবাদত ইত্যাকার একান্ত সময়ের ১১/১২ ঘন্টা ছাড়া বাকি ২/৩ ঘন্টা ঐ যে বাচ্চাদের সাথে সমবেত ব্যায়াম, মেডিটেশন, ইয়োগা, জামায়াতে নামাজ—যেকের। বাকি ২ ঘন্টা তাদের বিভিন্ন রুমে গিয়ে পর্যবেক্ষণ, তাদের সাথে শুয়ে—বসে মায়া—মমতা মাখামাখির সান্নিধ্য দিয়ে—নিয়ে তাদেরকে ফোনসেট থেকে বাবা—মা’র অধিকতর সন্নিকট—সান্নিধ্যের দিকে ধাবিত করা; কোনো কোনো সময় আপনার নিজ রুমে তাদের ডেকে এনে ঐরূপ সখ্যতা বাড়িয়ে দিয়ে তাদের ফোন—প্রীতিতে পরোক্ষভাবে বাধার সৃষ্টি করা অর্থাৎ বাবা—মা’র সাথে নিবিড় মিতালীতে ফোনের সাথে মিতালী—সুযোগটি বন্ধ করে রাখা।
এছাড়া ড্রইংরুমে সবাই সমবেতভাবে বেশি বেশি সময় কাটানো এবং প্রথমে আপনার নেতৃত্বে উপরোক্ত যৌথ কার্যক্রম করা; পরে ধীরে ধীরে একেক দিন বা একেক সময়ে একেক জনকে বলাÑ ব্যায়াম, দোয়া, মোনাজাত পরিচালনা করার জন্যে, নেতৃত্ব দেবার জন্যে। এরূপ কোয়ালিটি টাইম ব্যয়ের মাধ্যমে আপনার সাথে তারা যতবেশি গঠনমূলক যৌথ কার্যক্রম করবে, ততবেশি তারা ভবিষ্যতে আপনার এসব সরাসরি অবদানকে মনে রাখবে। তারাও আপনার মতো সিনিয়র সচিব বা তার চেয়েও বড় কিছু হয়ে অন্যদেরকে বলবে বা লিখবেÑ আমি আমার বাবার কাছ থেকে এসব শিখেছি, এসব চর্চা করেছি করোনা মহামারীর লকডাউনে। এভাবে তারা শিখবে প্রতিকূলতাকে কীভাবে জয় করা যায়, এরূপ প্রতিকূল সময়কে নিজের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অনুকূল করে স্কুল বন্ধের প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মহাকর্মযজ্ঞে কাজে লাগানো যায়।
আমি আপনার বাচ্চাদের যৌথ মেডিটেশন, ইয়োগা ও ব্যায়াম অনুশীলনের জন্যে কিছু ছবি ও ভিডিও পাঠাচ্ছি। এসব করার পর আপনারতো আর সময়ই থাকার কথা নয়। এরূপভাবে ওদেরকে সময় দিয়ে যদি আরো সময় আপনার হাতে থাকে, তাহলে তা আরো চমৎকার, আরো ভালো।
বললেন, কীভাবে? বললামÑ আপনি এ সরকারের এবং এ জাতির একজন নিষ্ঠাবান, ডায়ানমিক ও প্রতিভাধর কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যেসব কাজ করেছেন, যেসব অবদান রেখেছেন Ñসেগুলোর ওপর কিংবা জনগণের কল্যাণে, দেশ ও জাতির উন্নয়নে আগামীতে কীরূপ কাজ করা যায়, তার ওপর বই লিখুন কিংবা পত্রিকায় কলাম লিখুন। করোনা মহামারীর লাগাতার শাটডাউন আপনাকে কি সেই অপরূপ সুযোগটি দিয়ে দেয়নি!
বললেন- ওয়ান্ডারফুল, দারুণ আইডিয়াতো! বাচ্চাদের মাত্রাতিরিক্ত ফোন—প্রীতির বিষয়ে আপনার সাথে আলাপ করতে গিয়ে অনেকগুলো বিষয়ে খুব ভালো আইডিয়া পেয়ে গেলাম। এখনই তা শুরু করি। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রতিকূলতা জয়ের তৃতীয় প্রসঙ্গঃ
এবারে প্রতিকূলতাকে জয় করা আমার এক ঘনিষ্ঠ সহচরের কথা বলবো। তার নিজ বয়ানে বাস্তব ঘটনাগুলো হুবহু নিম্নরূপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়–য়া একটি মেয়ের ভীষণ আকুতিতে, আগ্রহে তাকে বিয়ে করেছিলাম; একবার নয়, দু’বার দু’কাজী অফিসে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে। প্রথমবার তার পীড়াপীড়িতে দু’জনে কাজী অফিসে গিয়ে। দ্বিতীয়বার তার শিক্ষাবিদ বাবা, তথা আমার পরম শ্রদ্ধেয় শ্বশুরের উপস্থিতিতে অন্য আরেক কাজী অফিসে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে। প্রথমবার বিয়ের পর তারই মুখে তার অতীতের সতীত্ব হারাবার কথা জেনেও মন খারাপ হয়নি, বরং তার এরূপ সত্যকথনের প্রতি বিমুগ্ধ হয়ে পারিবারিকভাবে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই এবং বিয়ের কয়েক সপ্তাহের মাথায় তার নামে আমার থাকার ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি করে দেই।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়া শেষে বাচ্চাদেরকে আমার কাছে রেখে তাকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার এমএস করতে এবং পুনরায় পিএইচডি করতে পাঠাই। তার পরিবার থেকে আপন বড় বোন তার বিদেশ—উচ্চশিক্ষায় বাধা দেয় এ কারণে যে, ছোটবোন বিদেশ—ডিগ্রিতে ডক্টর হয়ে আসলে পরিবারে বড় বোন ও বোনাইয়ের সমীহ—মূল্য কমে যাবে। এরূপ বাধার মুখেও স্বভাবজাত নিষ্ঠাবান স্বামী হিসেবে আমি তাকে সমর্থন, সর্বতো সহযোগিতা ও উদার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রিধারী করি। শিশু—সন্তানদেরকে আমার দায়িত্বে রেখে তাকে নির্ঝঞ্জাট অধ্যয়নে বার বার বিলেতসহ বিভিন্ন দেশে পাঠাই। অবশেষে ডক্টর হয়ে দেশে এসে বিভিন্ন পদ—পদবীতে ক্ষমতাবান হয়ে টকশোসহ বিভিন্নভাবে মিডিয়ার ব্যক্তিত্ব—দাপটের উগ্র—অহংকারে আমাদের প্রতিভাবান ৩ সন্তানসহ আমার পিঠে ছুরি মেরে আমার বড় সাধ ও সাধনার ২৪ বছরের সাজানো ঘর—সংসার ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় তার পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে।
স্বামীকে কোনো কারণ না জানিয়ে, স্বামীর সাথে কোনোরূপ আলাপ—আলোচনা, আল্টিমেটাম কোনো কিছু ব্যতিরেকেই, এমনকি পারিবারিক কোনোরূপ আলোচনা—বৈঠক ছাড়াই তার অসুস্থ বাবা—মা অজ্ঞান ও মুমূর্ষ অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালীন তার উগ্র—উচ্ছৃঙ্খল একক স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে অকস্মাৎ ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়; বিভিন্ন মুরুব্বী বা আত্মীয়স্বজন সবার অনুরোধ—উপদেশ উপেক্ষা করে; এমনকি আমার ভুল না থাকা সত্ত্বেও অজানা ভুল—ভ্রান্তির কল্পিত অপরাধের প্রসঙ্গ টেনেও তার কাছে ক্ষমা চেয়ে অবোধ—অবুঝ বাচ্চাদের স্বার্থ বিবেচনা করে সংসার না ভাঙ্গতে অবিরাম অনুরোধ করার পরও সে তার আত্মঅহংকারে অনড়ই থাকে।
এরপরই তার ডিভোর্সের কারণ অনুসন্ধানে সবার কাছে ধরা পড়ে যায়, তার আলগা আবেগে জড়িয়ে যাবার কথা। সেই কারণে তারই ডিভোর্স লেটারের প্রেক্ষিতে সিটি কর্পোরেশনের বারংবার আহ্বানকৃত শুনানী—সভায় কিংবা পারিবারিক জজ আদালতের শুনানীর কোনো সেশনেই সে যায়নি। এমনকি মানুষ বলাবলি করছিল- ‘মহিলা হয়ত অন্যত্র কোনো আবেগে কিংবা কারুর সাথে কমিটমেন্টে জড়িয়ে গিয়েছে, তাই তার দৃষ্টিতে এখানে এসে তার কোনো লাভ নেই...’। অর্থাৎ কি জানি কিসের অন্ধ নেশায় তার ৫০ বছর বয়সে এমনই ভীমরতি! অন্য পুরুষে তার আবেগের কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে তখন থেকে, যখন সে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েই নিজকে সিঙ্গেল মাদার ঘোষণা করে দিয়ে শিশুসহ ৩ অবোধ—অবুঝ সন্তানকে আয়া—বুয়ার কাছে রেখে ঢাকার বাইরে যাবার কথা বলে দিবারাত্রি একা একা ভোগবাদী অভিসারী জীবনযাপন করতে থাকে।
অবশেষে পরিবার ভাঙ্গনের শিকার এই আমি সম্পূর্ণ একা। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় দুর্যোগ কিংবা প্রতিকূলতা আর কি হতে পারে! প্রথম কিছুদিন কেমন খারাপ লেগেছে, তা এরূপ পরিবার—সন্ত্রাসীর অকারণ নিষ্ঠুর নির্যাতনে ভুক্তভোগী হওয়া ছাড়া অন্যদেরকে বুঝানো কঠিন। তাই সে কষ্ট কাটাতে বিশেষত সন্তানদের জন্য, আরো বিশেষত ছোট্ট অবোধ শিশু—সন্তানটির বুকভাঙ্গা কষ্টগুলো প্রশমিত করতে সুদীর্ঘ দু’টি বছর সময় লেগে যায়।
এরপর আবিষ্কার করলাম- একা থাকায়ও অনেক লাভ, অনেক প্রাপ্তি। সৎ চিন্তা ও গঠনমূলক জীবনাচার হলে এরূপ প্রতিকূলতায়ও মানুষ নিজকে করে তুলতে পারে সুমহান; করতে পারে নিজকে নবউদ্দীপনায় নব জাগরণে উদ্ভাসিত। যেমনটি করেছিলেন সুদীর্ঘ কারাপ্রকোষ্ঠে নির্জন একা জীবনে থাকা নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অং সান সুচি এবং এরূপ মহান ব্যক্তিত্বগণ।
কারাজীবনে একা থাকারও বহুবিধ উপকার রয়েছে। সেই উপকারের পরিমাণ ও গুণগতমান নির্ভর করে নিজ নিজ Belief System বা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
আসলে Positive Belief System এর মানুষদের একা থাকার এমনকি কারাবাসেরও মাল্টিডায়মেনশনাল ও স্পিরিচুয়াল বহু বেনিফিট রয়েছে। অতীব সংক্ষেপে সেরূপ উপকারের কিছু কিছু এখানে উল্লেখ করছি-
i) ধর্মকর্ম, আধ্যাত্মিক চর্চা, স্রষ্টার আনুকূল্য ও প্রকৃতির শক্তির সাথে নিবিড় সংযোগ ও সুসম্পর্ক স্থাপন সহজ হয়ে যায়।
ii) আত্মউপলব্ধি, আত্মসংশোধন, আত্মউন্নয়ন, আত্মার মহাজাগরণ ও প্রভূত আত্মশান্তি লাভ করা যায়।
iii) যেকোনো বিষয়ের চিন্তায়, নিবিড় অধ্যয়নে, অনুশীলনে, গ্রন্থ—কলাম লেখালেখিতে গভীর মনোযোগী হওয়া সহজ হয়ে যায়।
iv) সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষ, পরিবার, সমাজ, স্বদেশের কিংবা বিশ্বের সমস্যা অনুধাবন ও এসব সমস্যার অধ্যয়নগত সমাধান ও আধ্যাত্মিক চর্চায় সমাধান লাভ করা যায়।
v) সুগভীর গবেষণামূলক কার্যক্রমে একা থাকা অপরিহার্যও বটে।
vi) যিনি বা যারা অন্যায় পন্থায় আমাকে একাকীত্বে ফেলেছে, তাদের কৃত অন্যায়ের প্রেক্ষাপট বুঝা এবং তাদের এরূপ পুনঃঅন্যায়—অবিচার থেকে অন্য মানুষদেরকে বিশেষত ভবিষ্যৎ মানবসমাজকে সতর্ক—সাবধানে হুঁশিয়ার করার জন্য লেখালেখি করা কিংবা কালের সাক্ষী হিসেবে গ্রন্থ রচনা করা সহজ হয়ে যায়।
এরূপ আরো বহুবিধ উপকারলাভ করতে পারে একা থাকা পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষরা। নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গিধারীদের কথা এখানে পুনরায় নাইবা বললাম।
বাংলাদেশে, বিশেষত আমাদের দেশ ও জাতিতে প্রোএকটিভ ও পজিটিভ এটিচিউডের একজন ধারক ও বাহক হিসেবে আমি কিন্তু উপরে উল্লিখিত সবগুলো ক্ষেত্রে সাধন চর্চা করে প্রভূত লাভবান হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।
তাই বিপথগামী স্ত্রী কতৃর্ক হঠাৎ পরিবার ভাঙ্গন কবলের চরম প্রতিকূলতার ৩য় বছর থেকে আমার একা জীবনে সাধন চর্চার সুফল আসতে থাকে। এসবের অনেক কিছুই আমি অর্জন করতে পারতাম না; যদি ঐ পরিবার—সন্ত্রাসী স্ত্রী আমার ওপর পরিবার—সন্ত্রাসের নিষ্ঠুর নির্যাতন না করত। অর্থাৎ অকস্মাৎ আমাকে তার থেকে একা না করত। এ স্বল্প পরিসরে শুধু ছোট্ট ১টি বিষয় উল্লেখ করছি।
আমি ছোটবেলা থেকে নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আসছি এবং আজতক কোনো ওয়াক্ত নামাজ পড়িনি বলে আমার জানা নেই; এমনকি প্রতিওয়াক্তে অন্তত দু’ রাকাত নফল নামাজ পড়া আমার নিয়মিত অভ্যাস। তদুপরি তার ডিভোর্স লেটার পাবার পরের রাত থেকে এত বছরে কেনো রাতে অন্তত ৪ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ না পড়ার কথা আমার মনে আসছে না, আলহামদুলিল্লাহ। অথচ ঐ নারীর সাথে ২৪ বছরের দাম্পত্য—জীবনে আমি একদিনও তাহাজ্জুদ পড়তে পারিনি, আস্তাগফিরুল্লাহ..।
মূল কারণ, সঙ্গদোষ! বড় দোষ!! এ নারীর অন্য ৩ ভাই—বোন; তন্মধ্যে তার বড় বোন ও বোন—জামাই মুসলিম হয়েও নামাজ বা ধর্মকর্ম করে না। এ নারীও তার বাবার সংসারে বড় বোন এবং বোন—জামাইয়ের মতোই নামাজ বা ধর্মকর্মে তেমন সচেতন ছিল না। আমার সাথে বিয়ের পর আমার নির্দেশনা ও অনুকরণে নামাজ—রোজা অনেকটা নিয়মিতই করত। এখন আবার ঐ পূর্বরূপের চেয়েও অধিক অবক্ষয়ে পড়ে এই করোনা শাটডাউনে সে লাল টিপ পরে ফেইসবুকে লাইভ গান ছড়িয়ে কিংবা টকশোতে অংশগ্রহণের ছবি রেফার করে মজা পেতে প্রয়াসী হয়। কিন্তু আমার তাতে কোনো ভ্রম্নক্ষেপ নেই। শুধু কখনো—সখনো ৩ অবুঝ সন্তানের কথা মনে করে একটু আফসোস হয়- এরূপ টিপ পরা লাইভ গানের বেচারী মা’র মুসলিম সন্তানগুলো কী আদর্শ শিখল করোনা মহামারীর লকডাউনে একই ঘরে তার সাথে থেকে? তাছাড়া এরূপ মা’র সন্তানকে আরেক মুসলিম পরিবারের সুসন্তান কর্তৃক বিবাহ করার সম্ভাবনা কি নষ্ট করে দিচ্ছে না, তাদেরই বিভ্রান্তকারী এই মা?
যাই হোক, জীবন কিন্তু প্রত্যেকের যার যারটা। তাই আমার স্রষ্টার সাথে আমার সম্পর্ক চর্চা নিয়েই আমি থাকি। আলহামদুলিল্লাহ, তিনি আমাকে বহুরূপী রহমত—বরকতে এত্ত ভালো রেখেছেন, যার জন্য তাঁর কাছে অসীম—উচ্ছ্বাসে কৃতজ্ঞতা।
প্রিয় পাঠক, একটু সচেতনভাবে চিন্তা করে দেখুনÑ আমার এ ঘনিষ্ঠ সহচর কীভাবে তার জীবনের অতিভয়ঙ্কর প্রতিকূলতাকে জয় করে ফেলেছে অবলিলায়। এ পরিসরে শুধু তাকেই আমি অভিবাদন জ্ঞাপন করব না, অধিকন্তু প্রিয় পাঠক হিসেবে আপনাদেরকেও আমি আগাম স্বকৃতজ্ঞ অভিবাদন জানাচ্ছি প্রতিকূলতাকে জয় করার মাধ্যমে জীবনমানের বৈপ্লবিক উন্নয়ন—অগ্রগতি এবং মানুষকে ও দেশকে অনেক কিছু দেবার জ্ঞান—মানসিকতার দীক্ষা গ্রহণের জন্যে। আসুন-
আর যেনগো আমরা কেউই
প্রতিকূলতাকে ভয় না পাই কোনোই।
সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে
চলে আসি সবাই সুউন্নত জীবন—যাপনে।
আমাদের প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই আছে অফুরান—অসীম শক্তি; শোককে বা প্রতিকূলতাকে নতুন শক্তিতে রূপান্তর করে স্বর্গে যাবার নজির। আবার মানুষের মধ্যেই আছে নেগেটিভ বা ইবলিশী দৃষ্টিভঙ্গিতে শোক বা প্রতিকূলতায় ভেঙ্গে পড়ে নরকের দিকে ধাবিত হবার বহু উদাহরণ।
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ—নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
এমনকি এই আমারই ব্যক্তিজীবন থেকে অর্থাৎ আমার সাথে বহু মানুষের ভুল ও অন্যায় করা থেকে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। এজন্যই আমার সাথে মানুষ ভুল বা অন্যায় করলে আমি এখন ভিতরের জগতে খুশীই হই বেশি। কারণ আমার প্রতি তাদের ঐ অন্যায় আমাকে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের আরেকটি ক্ষেত্র বা দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আর সে সাথে এ বিশ্বাসেও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছি যে, Life is nothing, but solution of problems. And positive thinking always have a solution for every problem.
তাই আমি বিশ্বাস করি যে, আমার এ জীবনে হাজার সমস্যা আমাকে হাজার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়েছে বা দিবে। যেকোনো সমস্যা ও দুর্যোগ আমাকে আপাতত যতটা ক্ষতি করেছে, লাভবান করেছে ঢের বেশি এবং তা দীর্ঘমেয়াদে। তন্মধ্যে এ ক্ষুদ্র জীবনের সবচেয়ে বড় দু’টি ঘটনাÑ এক. মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ। দুই. প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগ, যেমন কভিড—১৯ এর লাগাতার শাটডাউন। এ দু’টি দুর্যোগই আল্লাহর রহমতের অজস্র বরকতে আমি সৃষ্টিসুখের আনন্দ—উল্লাসের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছি। যেগুলোর কিছু কিছু আপনাদের সাথে শেয়ার করেছি বিভিন্ন লেখায়। তন্মধ্যে বিশেষ একটি লেখা হচ্ছে ‘করোনা—মুক্তিতে স্রষ্টার অলৌকিক কারিশমা সকালে করোনা পজিটিভ আর বিকালে করোনা নেগেটিভ’ (www.helal.net.bd/bangla/special_col_details.php?Special_ID=75)
শত—সহস্র বছর পরে এবারের করোনা মহাদুর্যোগ এসেছে। স্রষ্টার কৃপায় একসময় হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে; আমরাও হয়তো ভুলে যাবো দুর্যোগ—প্রতিকূলতার কথা। হয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ দুর্যোগের ঘনঘটাকে অনুভবেই নিতে পারবে না। তাই আমাদের উচিত পরবর্তী প্রজন্মের সম্ভাব্য অহং মানসিকতাকে অবদমিত রেখে মানুষের সেবায় ও সৃষ্টির কল্যাণে বিশেষত সত্য—ন্যায় ও সুন্দরের সংগ্রামে নিবেদিত রাখার ক্ষেত্রে কিছু কাজ করে যাওয়া, কিছু পরামর্শ লিখে যাওয়া তথা এই করোনা অতিমারির উদাহরণে আগামীর অনুরূপ সতর্ক—সাবধানতার জন্য স্বাক্ষ্য—প্রমাণের কিছু দলিলপত্র রেখে যাওয়া; যাতে আবার ঐ শত—সহস্র বছর পরের অনাগত মহামারী—অতিমারীও সফল অতিক্রান্তের ক্ষেত্রে সেই সময়ের মানুষ এখনকার পরামর্শে সহজ—সাফল্য পেয়ে যায়।
তাইতো এ লেখায় উল্লেখিত কিংবা অনুল্লেখিত বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য থেকে আমি দু’ভিন্ন ধরনের বহুমুখী শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞানকে মানুষ ও মানবতার কল্যাণে বিশেষত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সতর্ক—সাবধানতার কিছু পরামর্শপত্র তৈরি করেছি এবং তাদের অসীম সুখ—সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান দিতে কিঞ্চিৎ হলেও সমর্থ হয়েছি। এসবই সম্ভব হয়েছে আমার পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি তথা Positive Belief System এ প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা এবং যেকোনো পরিস্থিতিতেই সময়, সুযোগ ও স্থানের সহজ সদ্ব্যবহার করার কলাকৌশল প্রয়োগ ও সাধন চর্চার কারণে। তাই আসুন-
সত্য ও সুন্দরের জগতে এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চিন্তা—চেতনায়,
যা আপনার জীবনকে করবে মহাউপভোগ্য আর মহামধুময়।
—৬ আগস্ট ২০২০
লেখকঃ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক
ফোনঃ ৯৫৫০০৫৫, ৯৫৬০২২৫
web: www.helal.net.bd
e-mail: m7helal@yahoo.com