প্রাকৃতিক চর্চার মাধ্যমে বিশেষত প্রাকৃতিক খাদ্যচর্চা, নিয়মিত ব্যায়াম ও পরিমিত ঘুমের মাধ্যমে আমরা অনায়াসেই বহুরোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারি এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষা ও দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারি। এরূপ লেখা বহু কলাম, বই ও মডেল আমি পাঠকের সাথে শেয়ার করেছি বিভিন্ন সময়ে; এমনকি সেসবের অনেক কিছু অনলাইনেও ছড়িয়ে দিয়েছি (www.helal.net.bd/bangla/book8.php)।
এ পরিসরে একটিমাত্র খাদ্য তথা সামান্য একটি লেবুর বহুমুখী উপকারিতার কথা বলছি।
একটি লেবু দিয়েই শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে গ্যাস্টি্রক ও বদহজমসহ বহু অসুখ চিরতরে দূর করতে পারেন আপনি নিজে নিজেই। এমনকি প্রতিদিন লেবু খাওয়ার মাধ্যমে আপনার ইমিউনিটিকে বুস্টআপ তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারেন। এতে করে রোগ—ব্যাধি আপনার ধারেকাছেও আসতে পারবে না। তাই লেবুর সাথে কখন কী কী মিশিয়ে খেলে আপনার কোন্ কোন্ রোগ দূর হবে, তা জেনে রাখা হবে সবদিক থেকেই উত্তম।
মেদ—চর্বি কমানোর জন্যে-
লেবু খাওয়ার আগে সকালবেলা বাসিমুখে বা খালিপেটে কুসুম—গরম পানি যথেষ্ট পরিমাণে পান করতে হবে। তা না হলে খালিপেটে সরাসরি লেবুর রস খেলে গ্যাস—এসিডিটি বুক জ্বালাপোড়া ও বদহজমের সমস্যা থাকলে তা আরও বেড়ে যাবে। এ কারণে আগে গরম পানি খেতে হবে জাপানীজদের স্টাইলে। এর আধাঘন্টা পরে একটি লেবুর রস এবং এক চা—চামচ পরিমাণ খাঁটি মধু একগ্লাস হালকা কুসুম গরম পানির সাথে ভালো করে মিশিয়ে খেয়ে নিতে হবে। এই মিশ্রণ টানা সাত দিন খেলে ধীরে ধীরে আপনার মেদ—চর্বি অবশ্যই কমতে শুরু করবে।
যাদের গ্যাস—এসিডিটিতে বুক জ্বালাপোড়া ও বদহজমের সমস্যা বেশি, তারা কিন্তু সকালবেলা এভাবে খালি পেটে লেবুর রস খাবেন না। এতে করে আপনার ঐ সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি লেবু খাবেন দুপুর বেলায় খাবারের আধাঘন্টা পরে। দুপুর বেলায় ভারী খাবার খেলে খেয়াল রাখতে হবে, যেন সেই খাবারে দুধ জাতীয় কোনো খাবার না থাকে। দুধ জাতীয় যেকোনো খাবার বা ডেজার্ট খাবার পরে লেবু না খাওয়াই ভালো। এতে বদহজম বা পেটের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। যদি আপনি এই ধরনের ডেজার্ট বা দুধ জাতীয় খাবার না খান, তাহলে দুপুরে আহারের আধাঘন্টা পরে একগ্লাস হালকা গরম পানি নিয়ে এরমধ্যে একটি সম্পূর্ণ লেবুর রস দিয়ে এর সাথে মধু মিশিয়ে নিতে হবে। সাথে পাহাড়ী লবণ মিশিয়ে নিতে হবে। পিং সল্ট অর্থাৎ রক সল্ট যদি না থাকে, তাহলে এক চিমটি বিট লবণ মিশিয়ে নিতে হবে। কিন্তু যাদের হাই ব্লাডপ্রেশার আছে কিংবা হাই ক্লোরেস্টেরলের সমস্যা আছে, কিডনি ফাংশনের সমস্যা আছে; তাদের ক্ষেত্রে এক চিমটি বিট লবণ কিংবা রক সল্ট মেশানোই ভালো। কারণ, রক সল্ট এই ধরনের সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয় না।
ফুসফুস পরিষ্কারসহ শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথা, শুষ্ককাশি বা বুকে জমা কফ দূর করার জন্যে-
প্রথমে একটি লেবু অর্ধেক করে মাঝ বরাবর কেটে নিতে হবে। তারপর লেবুর সেই অর্ধেক অংশকে হালকাভাবে গরম করতে হবে। সেক্ষেত্রে লেবু এমন একটি পাত্রে নিতে হবে, যাতে হালকাভাবে গরম করা যায়। হালকা আঁচে অর্ধেক লেবুকে গরম করতে করতে সেখানে তিনটি উপাদান মিশিয়ে দিতে হবে। প্রথমে তিন চারটি কালো গোলমরিচের গুঁড়ো তাৎক্ষণিকভাবে অর্ধেক লেবুটির উপরিভাগে মিশিয়ে দিতে হবে। এর সাথে আধা চা চামচ পিপুল গুঁড়োও মিশিয়ে দিতে হবে। পিপুল অনেক মুদি দোকানে কিংবা ভেষজ ওষুধের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। আধা চা—চামচ পিপুল গুঁড়ো সেই অর্ধেক লেবুটির উপরিভাগে গোলমরিচের গুঁড়োর সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। হালকা আঁচে থাকা অবস্থাতেই পিপুল এবং গোলমরিচের গুঁড়োর সাথে আধা চা—চামচ পিং সল্ট মিশিয়ে দিতে হবে।
সাধারণ লবণ প্রেশার বাড়ায় এবং কিডনির কার্যক্ষমতার ক্ষতি করে, কিন্তু পিং সল্ট এসবের কোনো ক্ষতি করে না কিংবা সমস্যা বাড়িয়ে দেয় না, বরং উপকার করে।
দুই/তিন মিনিট হালকা আঁচে গরম করার পরে একটি কাঁচের পাত্রে সম্পূর্ণ লেবুর রসটা নিংড়ে বের করে নিতে হবে। এই রসের সাথে এক চামচ পরিমাণ খাঁটি মধু মিশিয়ে নিতে হবে। খুব ভালো করে এই মিশ্রণটি তৈরি করার পরে হাতের তালুতে নিয়ে ধীরে ধীরে চেটে খেতে হবে। চেটে চেটে খেলে এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করবে। যখনই আপনার কাশি, গলাব্যথা বা হঠাৎ করে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হবে, এই মিশ্রণটি তৈরি করে তৎক্ষণাৎ খেয়ে নিতে হবে। হালকা গরম অবস্থায় খেলে এটি অনেক ভালো কাজ করে এবং এই মিশ্রণ খাওয়ার পর এক গ্লাস হালকা কুসুম গরম পানি পান করতে হবে। হালকা কুসুম গরম পানি পান করার পর ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথা ইত্যাদি সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। ফুসফুস পরিষ্কার হবে।
ফুসফুসে আগে যদি কোনো ইনফেকশন থেকে থাকে, সেই ইনফেকশন দূর করতে এই লেবু—মধু মিশ্রণের কোনো জুড়ি নেই। যদি কারো দীর্ঘদিনের সর্দিকাশির সমস্যা থাকে, তাহলে এই মিশ্রণ দিনে দুইবার করে খেতে হবে। এতে এই ধরনের সমস্যাগুলো পুরোপুরি দূর হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে দিনের অন্য কোনো সময়ে আর লেবুপানি খাওয়ার প্রয়োজন নেই। আরেকটি বিষয় খুব ভালো করে মনে রাখতে হবেÑ যদি আপনি ওজন কমানোর জন্য লেবুপানি খান, কিংবা আপনি যদি বদহজম, গ্যাস—অম্বল ইত্যাদি কমানোর জন্য লেবুপানি খান; তাহলে কিন্তু এই মিশ্রণ দিনে দুইবারের বেশি খাওয়া যাবে না। কারণ, লেবুর রসের মিশ্রণ অহেতুক বেশি বেশি খেলে বুকজ্বলা, গ্যাস্টি্রক ইত্যাদির সমস্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে বুঝে—শুনে পরিমাণ মতো খেতে হবে।
একজন মানুষের জন্য সারাদিনে একটির বেশি লেবু খাওয়ার প্রয়োজন নেই। সারাদিনে একটি লেবুই একজন মানুষের জন্য যথেষ্ট। সেটা কাগজি লেবু, পাতি লেবু কিংবা এলাচি লেবুই হোক। লেবুর অত্যধিক পরিমাণে ভিটামিন—সি কিন্তু শরীরের জন্য মোটেও ভালো না, বরং অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঠান্ডা কাশিজনিত সমস্যায় রাতে বিছানায় শোয়ার পরে যাদের খুশখুশে কাশি, সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া; মাথা—ব্যথা করা এই ধরনের সমস্যাগুলো হয় এবং কাশির জন্য ভালো করে যারা রাতে ঘুমাতে পারেন না, তারা ঘুমানোর আগে আগে এই মিশ্রণটি তৈরি করে খেয়ে নেবেন।
যেহেতু মিশ্রণটিতে লেবুর রস, গোলমরিচ, লবণ ও পিপুল রয়েছে; তাই এটির আধিক্য গ্যাস, অ্যাসিডিটি ও বদহজমের সমস্যা অতি সহজেই দূর করে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, লেবু খেলে রাতে কিন্তু দুধ জাতীয় কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। রাতে দুধ না খেয়ে এই মিশ্রণটি খাওয়ার ফলে পেটের যাবতীয় সমস্যা অতি সহজেই দূরীভূত হয়ে যাবে।
এসিডিটি, বদহজম, কোষ্টকাঠিন্যের সমস্যা দূর করার জন্যে -
কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে সেই সমস্যাও দূর হয়ে যাবে। মিশ্রণটি শ্বাসকষ্ট, অ্যাসিডিটি ও বদহজমের সকল সমস্যা খুব অল্প সময়েই পুরোপুরি দূর করতে সক্ষম। এই মিশ্রণটি শরীরের ইমিউনিটি ব্যাপকভাবে বুস্ট করতে সক্ষম, যদি লাগাতার নিয়ম করে কয়েকমাস খাওয়া যায়। শুধু রাতে না খেয়ে দিনের অন্য সময়েও নিয়ম করে এই মিশ্রণটি খেলে আরও বহুবিধ উপকার পাওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র খাওয়ার নিয়মগুলো সঠিকভাবে মেনে খেতে হবে। এই মিশ্রণটি খাওয়ার পরে আধাঘন্টার মধ্যে অন্য কোনো কিছু কোনোভাবেই খাওয়া উচিত হবে না। এই মিশ্রণটি খেলে ইমিউনিটি এতোবেশি বুস্ট হবে যে, আপনার শরীরে কোনো রোগ টিকতে পারবে না।
এভাবে একটি লেবু দিয়েই শ্বাসকষ্ট, গ্যাস্টি্রক ও বদহজমসহ অনুরূপ বহু অসুখ চিরতরে দূর করার এই অত্যাশ্চর্য উপায়ের মাধ্যমে নিজেকে সুস্থ—স্বাভাবিক ও নিরোগ রাখা সম্ভব।