জীবন—সাফল্যের অন্যতম সোপান হচ্ছে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। এটি মানব চরিতের বিশেষ গুণাবলির মধ্যে অন্যতম এবং সবারই সর্বক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। এমনকি অন্যের কাছে ঠকে গিয়েও আপনি যদি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় অবিচল থাকতে পারেন, তাহলে স্রষ্টার অশেষ কৃপায় শেষতক আপনিই জিতে যাবেন।
সেরূপ অনেক বাস্তব সুফল আমার ব্যক্তিগত জীবনে বহুবার পেয়েছি নানাভাবে। বিশেষত অন্যের দ্বারা ঠকে গিয়েও কিংবা প্রতারিত হয়েও প্রোএকটিভ ও পজিটিভ এটিচিউডে ধৈর্য ধরে থাকার ফলে উপরওয়ালা আমাকে ঐ ঠকে যাওয়ার কয়েকগুণ লাভ দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে আমার নিজ জীবনের কয়েকটি উদাহরণে যাবার আগে অন্য এক বিশিষ্টজনের বাস্তব একটি উপাখ্যানের কথা বলে নেই।
সাইদুর রহমান সজল; ভূমি—ব্যবসা হচ্ছে পেশা, আর সংস্কৃতি চর্চা তাঁর নেশা। তিনি একজন ভাবাবেগী মানুষ। সততা, ভালো—মন্দ মিশিয়ে এভারেজ। বাবা আলহাজ্ব সাবদার হোসেন; খুবই সৎ ও ন্যায়পরায়ণ এবং সবারই শ্রদ্ধা পাওয়ার মতো সমাজের অনুকরণীয় আদর্শ বাবা তিনি। সজল ভাইয়ের বাবাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, আর এই সুপুত্রের মুখে প্রিয় বাবা সম্পর্কেতো শতবার শুনেছি। বৃদ্ধ বাবাকে এত গভীর ভক্তি—শ্রদ্ধা করা, সঙ্গ—সময় দেয়ার মতো অনুরূপ সুযোগ্য সন্তান সজল ভাইয়ের মতো আর দেখিনি।
পারিবারিক দাওয়াতের বাইরেও ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানাদির যেখানেই তিনি কোনো দাওয়াতে বা উপভোগ—আয়েশে যেতেন, বাবাকে তাঁর সাথে নেয়া চাই—ই চাই। যতবারই সজল ভাইকে আমার প্রাতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে কিংবা বাসায় নিমন্ত্রণ করেছি, তিনি তাঁর সুপ্রিয় ও সুহৃদ বন্ধুতুল্য বাবাকে সাথে আনতে কখনোই মিস করেননি। এমনকি মধ্যরাত অবধি বৃদ্ধ বাবাকে সঙ্গে নিয়েই চলতো জমজমাট গল্প—আড্ডা। বাবাকে শ্রদ্ধা এবং বাবা—ছেলে নির্ভরতার গভীর সম্পর্ক আকাশসম করে তুলে পৃথিবীর সমস্ত জঞ্জাল পানির মতো সহজ করে যে ফেলা যায়, সম্মানীত পাঠকের সাথে সেইরূপ দীক্ষা দেয়া—নেয়ার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে এতটুকুন অপ্রাসঙ্গিক কথা বললাম। এখন আসি সজল ভাইয়ের অপরিসীম ধৈর্য ও পরম সহিষ্ণুতায় তাঁর প্রতি স্রষ্টার অনুপম দান ও রহমত—বরকত সম্পর্কে।
বড় মগবাজারস্থ নিউ ইস্কাটন দিলু রোডের একেবারে শেষ প্রান্তে প্রায় ১০ কাঠা জমি কিনেন সজল সাহেব। কিন্তু ভাগ করার সময়ে ভাই মোজাম্মেল হোসেন নেন সামনেরটা, সজল সাহেবকে দেন পেছনেরটা। সজল সাহেব তা মেনে নেন ভাইয়ের সাথে সৌহার্দে্যর খাতিরে। আমাদের প্রিয় সজল ভাইতো তাঁর সুপ্রিয় বাবাকে নিয়ে, বাবার হয়ে, বাবার জন্যেই মাতোয়ারা। বাবা—কাতর এ ছেলের কাছে জায়গা—জমির মতো বৈষয়িক বিষয়াদি বাবার তুলনায় তুচ্ছ। তাইতো কয়েক বছর পর সরকার হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ হাতে নিলে সজল সাহেবের
পোয়া বারো হয়ে
ভাগ্য যায় খুলে।
কারণ সজল সাহেবের বাড়ির পেছনের দেয়ালে একটা গেট খুলে দিতেই তাঁর বাড়িটি হয়ে গেল আধুনিক হাতিরঝিলের সাথে উদার—উদাস খোলামেলা, সুপ্রশস্ত, প্রাকৃতিক পরিবেশ মন্ডিত এবং অত্যাধুনিকতায় সুউন্নত। আর ইস্কাটনের দিক থেকে দিলু রোডে তাঁর ভাইয়ের সামনের বাড়িটি হয়ে গেল হাতিরঝিলের দিক থেকে সজল সাহেবের পেছনের বাড়ি। অর্থাৎ ঐ ভাইয়ের বাড়ি চলে গেল আগরতলা থেকে উগিরতলা, আর সজল সাহেবের উগিরতলার বাড়ি এখন সুউন্নীত হলো আগরতলায়। মারহাবা; রাখে আল্লাহ মারে কে!
ভাইয়ের অবিচার ও প্রবঞ্চনার প্রতি রিএকটিভ না হয়ে সজল সাহেব প্রোএকটিভ হয়ে স্রষ্টার প্রতি পজিটিভ এটিচিউডে ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু থাকার ফলে স্রষ্টা নিজ হাতে তাঁকে বিশেষ গিফ্ট দিয়ে দিলেন।
এবারে আমার জীবনে ধৈর্য—সহিষ্ণুতায় সুফল লাভের অনুরূপ কয়েকটি বাস্তব গল্প বলছি।
১৯৯৮ সালে আমাদের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী অফিস স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ৩৩ তোপখানা রোডে আমরা প্রথমে ১টি স্যুট বুকিং দেই। সে সময়ে দি সিটি ব্যাংক লিঃ এর সুদক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্বাস উদ্দীন আহমেদ আমাকে বললেন, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এমনকি পুরো বাংলাদেশের সেন্ট্রালে তথা জিরো পয়েন্টে এরূপ একটি অফিস করার সুবর্ণ সুযোগকে উত্তমভাবে কাজে লাগাও। বললেন, ৫টি স্যুট নিয়ে নাও। বললাম, টাকা বা ক্ষমতা কিছুই নেই আমাদের। বললেন, আমি ব্যবস্থা করে দেব; সহজ শর্তে ও সর্বসুবিধায় ব্যাংকলোন দিয়ে দেব। বললাম, তাহলে ব্যাংক—ঋণের দায়—দেনায় আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে। বললেন, আরে না; লোন পরিশোধের ব্যবস্থাও আমিই করে দেব।
এরপর মহৎপ্রাণ, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ ব্যাংকার ব্যক্তিত্ব আব্বাস উদ্দীন আমার মাধ্যমে শিক্ষা ও যুব উন্নয়নের মহতী উদ্দেশ্যে যেসব কাজ করে দিলেন, তা বিস্তারিত বলবো অন্যলেখায়। অবশেষে সুপ্রিয় আব্বাস ভাইয়ের সক্রিয় ও উদাত্ত পৃষ্ঠপোষকতায় ৫টি স্যুট ক্রয়ে সম্মত হলাম।
ভবনের সামনের দিক তথা দক্ষিণ পাশে তোপখানা রোড সংলগ্নে ব্যস্ত সড়ক থেকে যানবাহনের বিকট শব্দ ও বায়ু দূষণের আশংকায় আমরা ভবনের পেছনের দিক তথা উত্তর দিকে ৫টি স্যুট বুকিং দেই। কিন্তু পরবর্তীতে চূড়ান্ত বরাদ্দের সময় ডেভেলপার অন্য ক্রেতার কাছ থেকে আমাদের ক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি বিক্রয়মূল্য আদায় করে আমাদের বুকিংকৃত স্যুট অন্যদেরকে দিয়ে দেয়। আর আমাদেরকে দক্ষিণ পাশে অর্থাৎ রাস্তার দিকে ফেলে দেয়। এ স্বেচ্ছাচারী পরিবর্তনের প্রতিবাদে আমার সহকর্মীরা কিছুটা উচ্চবাচ্য করতে চাইলেও আমি ডেভেলপারকে কিছুই বলিনি, কেবল আলহামদুলিল্লাহ ছাড়া। কারণ এটিও হয়তো আমাদের মঙ্গলের জন্যই হয়েছে।
এরপর সবাই যখন ভবনে উঠল, তখন দেখা গেল আমাদের ফ্লোরে তথা এই স্যুটগুলোর দক্ষিণ পার্শ্বের বিশাল দেয়াল গোল্ডেন কালার থাই গ্লাসের। আর আমাদেরকে বঞ্চিত করা ঐ স্যুটগুলোর গ্লাস ডার্ক কালারের এবং তার পার্শ্ববর্তী ভবনগুলো এত উঁচু, দূরের দৃশ্য দেখা যায় না। অন্যদিকে আমাদের স্যুট থেকে দেখা যায় সুবিশাল ঢাকা শহর, বিশেষত শহরময় রাতের আলোকসজ্জা এবং ঢাকা স্টেডিয়ামের খেলাধুলা ও আতশবাজি, আনন্দরাজি; সবকিছুই আমাদের স্যুট থেকে আরাম—আয়েশে বসে বিনাটিকিটে বিনাপয়সায় দিন—রাত মন ভরে সহজেই উপভোগ করা যায়। অধিকন্তু দক্ষিণের আলো—বাতাস এমনই প্রকৃতির এয়ারকুলারে ভরপুর যে, মাঝে মাঝে লোডশেডিংয়েও আমাদেরকে অসুবিধায় পড়তে হয় না, আলহামদুলিল্লাহ। ঠকে যেতে গিয়ে উল্টো জিতেই গেলাম মহান রাব্বুল আলামিনের অশেষ কৃপায়।
এবারে ঐ প্রসঙ্গে আরেকটি গল্পঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে আমি যখন শিক্ষা ও যুব উন্নয়নে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচির সুদূরপ্রসারী বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় পার করছি, সেরূপ এক সময়ে আমার প্রতি নজর ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেয়ে। অন্য এক যুবকে ছঁ্যাকা খেয়ে সর্বহারা হয়ে আমার প্রতি এতই ক্রেজী আকর্ষণে পড়ে যায় যে, দ্রুত তাকে বিয়ে করতেই হবে এবং তা গোপনে। তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাকে নিয়ে যায় লালমাটিয়া কাজী অফিসে। বিবাহ রেজিস্ট্রি হয়ে যায় প্রথমবার। এরপর পুনর্বার বিবাহের আসর বসায় তার বাবার নিজ বাড়িতে। এবার আর গোপনে নয়, সবার উপস্থিতিতে। আত্মীয়—স্বজনসহ এবারও গেলাম তার কথামতো, তারই পরিকল্পনা মতো। এবারে বিবাহ রেজিস্ট্রি হয় মগবাজার কাজী অফিসে। একই জনের সাথে দু’কাজী অফিসে দু’বার বিবাহ রেজিস্ট্রি!!
আমার কিছুই করার ছিল না। ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে প্রথমটি ন্যায়সঙ্গত না হলেও তাতে আমার প্রতিরোধের সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ প্রথমবার একজনের ওষ্ঠাগত প্রাণ বাঁচাতে, দ্বিতীয়বার শ্বশুর মহাশয়ের বাড়িতে বিয়ের আসরে বসা অবস্থায় মান্যবর শ্বশুরসহ এত মুরুব্বীয়ানের সম্মুখে কাজীর ঠিকানা—পরিচয় পর্যন্ত জানবার কোনোই ফুসরত ছিল না। তাছাড়া একজনের ঐকান্তিক ইচ্ছার বাস্তবায়নে নিজকে উজাড় করে দিতে গিয়ে তাদের খুত ধরার মানসিকতা তথা নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়া তখন অর্থহীন বলেই মনে হয়েছিল।
সবার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়ে গেল। এ পর্যায়ে দু’জনের দু’শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে পরিচয়ের পর মূল্যায়ন সংক্রান্তে আলাপচারিতার কথকতা শুরু হয়ে যায়। সেই পর্বে আমার মা এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে ঐ রমণী কঠোরভাবে অবগত হয় যে, তার বর কোনোক্রমেই মিথ্যা সহ্য করে না, করতে পারে না। এটি ছাড়া বরের বাকি সব ভালো। অর্থাৎ এ বিয়েতে সে সৌভাগ্যবতী স—ব ব্যাপারেই, যদি সে বরের সাথে কোনোরূপ মিথ্যা না বলে। এটি ভালো করে বুঝতে পেরে বিয়ের পর সে আমাকে জানিয়ে দেয়, তৎপূর্বেকার তার একান্ত জীবনে ঘটে যাওয়া সকল গোপনতম কথা। এ বিবাহের পূর্বেই তার চরিত্র হারানোর কথা তারই নিজের মুখে শুনে আমিও তার সত্যকথনে বিমুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবাসতে থাকি। এমনকি আমার কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ—তিতিক্ষায় তিলে তিলে সঞ্চয়কৃত অর্থ দিয়ে কেনা বাড়ি—গাড়ি সবকিছু তার নামেই লিখে দেই অর্থাৎ সে—ই আমার সব। উপরুন্তু আমার উজাড়—উৎসর্গে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে উচ্চডিগ্রি অর্জন করানো, পদ—পদবীতে ও মিডিয়ার প্রভাব—প্রতিপত্তিতে ক্ষমতাবান বানানোসহ স—ব—ই করি।
অন্যদিকে ক্ষমতার অহংকারে সে মনুষত্ববোধ হারিয়ে স্বামী—সংসারের প্রতি উদাসীন এবং উদ্ধত—বেসামাল হয়ে ওঠে। এমনকি শিশু ও অবোধ সন্তানদেরকে ঘুমে রেখে সেই সকালেই বাইরে চলে যায় এবং রাতে সন্তান ঘুমিয়ে যাবার পর বাসায় ফেরে। এমনই এক শনিবারে অর্থাৎ তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকালে টকশো’র বাহানায় সে বাইরে যেতে উদ্যত হলে আমি সামনে এসে বলি, ‘ছুটির দিন হিসেবে আজ বাসায় থেকে সন্তানদেরকে সময় দাও প্লিজ’। এরূপ অনুরোধ করতেই সে তেলে—বেগুনে জ্বলে ওঠে এবং বলে দেয়, ছুটির দিন হলেও বাইরে যেতেই হবে। আমি তাতে একটু বাধ সাধতেই সে বিক্ষুব্ধ হয়ে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় আমার দীর্ঘদিনের সাজানো ঘর—সংসার—পরিবার এবং আমাদের মধ্যকার দু’যুগের সম্পর্ক।
তার অধ্যক্ষ—অধ্যাপক বিজ্ঞ—বিদগ্ধ বাবা—মাকে হাসপাতালে অচেতন রেখে, আমার সাথে কিংবা দু’পরিবারের সাথে এমনকি কারোর সাথে কোনোরূপ আলাপ—আলোচনা না করে, আমার সাথে কোনোরূপ অমিলের কিছু না বলে হঠাৎ আমার স্টাফের মাধ্যমে অফিসে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। আমাকে এসএমএস করে বলে, তার নামীয় ফ্ল্যাটে (তথা আমারই কিনে দেয়া ফ্ল্যাটে) আর না যেতে। এরূপ উচ্ছৃঙ্খল পারিবারিক মাস্তানি এতই আকস্মিকভাবে করে যে, তার দু’যুগের স্বামী কিংবা তার সন্তানদের বাবা ঐদিন—ঐবেলা কী খাবে, কিংবা সেই রাতে কোথায় থাকবে, এরূপ ন্যূনতম মানবিক হুঁশ—জ্ঞান কাজ করেনি তার অমনুষ্যচিত মনে। একতরফা আকস্মিক এবং অন্যায় ও অযৌক্তিক ডিভোর্স দিয়েই সে বিভিন্নভাবে নিবর্তন—নির্যাতন ও নানামুখী শত্রুতার ঘা বাসাতে থাকে।
তার অর্থ ও ক্ষমতার অহংকার—ঔদ্ধত্যের সাথে আলগা হাওয়ার আবেশে এমনই মাতাল হয়ে পড়েÑ সে ভুলেই গিয়েছে যে, আমার সাথে বিয়ের কিছুদিন পর তথা সে ছাত্রী থাকাকালীনই আমি আমার নিজ সঞ্চয়নের টাকায় কেনা ফ্ল্যাট তার নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছি।
ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচন্ড ধৈর্যশীল আল্লাহর অশেষ রহমতে। তাই অমনুষ্যচিত বিপথগামী ঐ নারী কতৃর্ক পরিবার ভাঙ্গন ও শত্রুতার তান্ডবে আমি অবাক—আশ্চর্য—বিস্মিত হলেও অসহিষ্ণু হইনি কখনোই। তার বিভিন্ন অত্যাচার—নিষ্ঠুরতা—নিপীড়ন একাকী সহ্য করে করে কেবল মহাপ্রভুর বর্ধিত কৃপা কামনা করতে থাকি; কখনো ড্রাইভিং সিটে, কখনোবা নিজ অফিস চেয়ারে ঘুমিয়ে। কষ্টার্জিত নিজ ফ্ল্যাট ভুল মানুষের উদভ্রান্তিতে হারিয়ে ফেলে এবং হঠাৎই স্ত্রী, সন্তানহীন হয়ে আমি সর্বহারা। এমনকি আমার থাকা—খাওয়ার বিকল্প সুযোগটুকুনও রাখেনি ঐ পাষন্ড নারী।
অবশেষে একদিন আমার স্টাফরা তার কাছ থেকে আমার কিছু কাগজপত্রের ফাইল ও কাপড়—চোপড় চায়। এসব একান্ত ব্যক্তিগত ও জরুরি জিনিসগুলো ফেরত না দিলে বেগতিক কিছু হতে পারে ভেবে তাদের কাছে সেসব দিয়ে দেয়। ঐসব ফাইলের একটির ভিতর দেখা যায়, আমার কর্তৃক তার নামে রেজিস্ট্রি করে দেয়া ফ্ল্যাটের দলিল, তার অতীত কুকর্মের ডক্যুমেন্ট, আমার সম্পর্কে তার স্বহস্তে লেখা বিভিন্ন আর্টিকেল ইত্যাকার বহুকিছু; যা সে সচেতনভাবে দিয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এ বিশ্বাসে আমি নিশ্চিত হয়েছি যেÑ আমার প্রতি এবং অবোধ শিশু—সন্তানদের প্রতি তার চরম অমানবিক নিষ্ঠুরতা, অমনুষ্যচিত অত্যাচার ও জঘন্য শত্রুতা স্রষ্টা সহ্য করেননি। তাইতো ঐসব তারই হাত দিয়ে এবং অফিস—স্টাফ হয়ে আমার কাছে চলে এসেছে। তাই এর সবকিছুই আমার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় স্রষ্টার বিশেষ দান বলে বিশ্বাস।
এ সংক্রান্তে স্রষ্টার আরো বহু দানের মধ্য থেকে আরেকটির কথা বলে এ প্রসঙ্গটি শেষ করবো।
আমার কষ্টার্জিত শ্রম ও অর্থে কেনা ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি স্ত্রীর নামে করে দেয়ার ক্ষেত্রে আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে সে যখন বলে দিল ‘আমার’ ফ্ল্যাটে এসো না, তার দু’সপ্তাহ পর একদিন ছোট বোন—জামাই আমার অফিসে এসে বলে, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্বপ্ননগর ভিআইপি হাউজিং প্রকল্পে নামমাত্র মূল্যে ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন ফরমে আমাকে স্বাক্ষর করতেই হবে।
তাকে বললাম, ফ্ল্যাট ছাড়া আমিতো ভালোই আছি, ফ্ল্যাট লাগবে না...। এসব শুনেও সে নাছোড়বান্দা হয়ে শেষতক ঐ ফরমে আমার স্বাক্ষর নিয়ে জমা দেয়। ৬ মাস পর জানা যায়, লটারিতে সাংবাদিক কোটায় আমার নাম ১ নম্বরে। তাও যে ভবনে আমার ফ্ল্যাট—নাম্বার পড়েছে, সে ভবনের পেছনে রয়েছে প্রাকৃতিক লেক, আর ভবনের সম্মুখে রয়েছে সরকার নির্মিত ফুটবল খেলার সুবিশাল মাঠসহ বহু সুযোগ—সুবিধা।
স্বপ্ননগরে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে থাকার এরূপ ভিআইপি ফ্ল্যাট সম্পর্কে তৎপূর্বে আমি কিছুই জানতাম না। আবেদন করা কিংবা লটারিতে এবং স্বল্পমূল্যে পাওয়াতো দূরের কথা। তাই শোকর আলহামদুলিল্লাহ। লটারিতে পাওয়া মানে কিন্তু আল্লাহর দান। তাঁর দানের দামে এরূপ পাওয়ায় আমার বা অন্যকারুর কোনো প্রভাব নেই। শুধু বোন—জামাইটার অবদান আছে। কারণ তারই আগ্রহে সাংবাদিক কোটায় আমাকে দিয়ে দরখাস্ত করিয়েছে এবং লটারিতে ১ নম্বরে উঠার ব্যাপারটাও আমাকে সে—ই জানিয়েছে।
এ ঘটনাসহ আমার জীবনে সরাসরি ঘটে যাওয়া বাস্তব বহু উদাহরণ এবং একজন ক্ষুদে সংবাদকর্মী হিসেবে হাজার মানুষের জীবনালেখ্য অধ্যয়নের মাধ্যমে আমি এ উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে, কিছু মানুষ অন্য মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করে বা করতে পারে; কিন্তু টষঃরসধঃবষু সে কিছুতেই ক্ষতি করতে পারে না। বিশেষত সৎ কর্মশীলদের সৎ কাজের ক্ষেত্রে এ কথা শতভাগ প্রযোজ্য। বরং এরূপ ক্ষতির চেষ্টায় প্রকারান্তরে এবং দীর্ঘমেয়াদে উল্টো সেই অত্যাচারকারীই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায় এবং স্রষ্টা বহুগুণে লাভবান করে দেন অত্যাচার সহ্যকারীকে, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় অটল থাকা মানুষকে। তাইতো সুহৃদ পাঠকগণের সাথে একান্তে বলছি-
সততা—ন্যায়নিষ্ঠা, ক্ষমা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতাকে অবলম্বন ও লালন করে আমার প্রতিদিনের চিন্তা ও কর্মে, আমার আপন ভুবনে আমি এতই মহানন্দে রয়েছি এবং প্রায় সর্বক্ষেত্রে মহান আল্লাহর এতই রহমত—বরকতের বর্ষণে আছি; যার জন্য আমাকে প্রতিরাতেই অন্তত দু’রাকাত তাহাজ্জুদ কিংবা শোকরানা নফল পড়তে হয় এবং তা করে মহাপ্রভুর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই হয়। বিশেষত যতটুকুন খেতে পারি, তিনি তার বহুগুণ আমার জন্য বরাদ্দ—সরবরাহ করেন কিংবা করিয়ে থাকেন। বিভিন্নজনকে বলি যে, আমার খাবার লাগবে না কিংবা ঐ খাবারটা আমার আছে; তারপরও তাঁরা কেন জানি এমন আবদারে—নিবেদনে খাবার দিয়ে যান, পাঠিয়ে দেন।
অথচ যার ছাত্রীজীবনে অন্য পুরুষের সাথে চরম সংকটের মহাবিপদ থেকে রক্ষায় তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এবং তৎপরবর্তীতে তাকে পদ—পদবী ও ক্ষমতায় আসীন করতে নিজকে রিক্ত—নিঃস্ব করেছি, সেই নারী কিনা আমার সাথে কোনোরূপ আলাপ না করে আমাকে ও সন্তানদেরকে মহাসঙ্কটের মানবেতর জীবনে ঠেলে দিয়েছে; বিশেষত ভেঙ্গে দিয়েছে অপার সম্ভাবনার অবোধ শিশুজীবন। অধিকন্তু লিপ্ত হয়েছে নিপীড়ন—নির্যাতন ও শত্রুতায় এবং আমার এক পা ভাঙ্গতে গিয়ে যেন তার দু’পাই ভেঙ্গে ফেলেছে। অনুরূপ এক গল্প দিয়ে এ লেখার ইতি টানছি।
এক গরিব ব্যক্তি প্রত্যহ তার দুঃখ—কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে প্রচুর কান্নাকাটি করত। আল্লাহ দয়া পরবশ হয়ে ফেরেশ্তা পাঠালেন। ফেরেশ্তা সে ব্যক্তির কাছে এসে বলল, আপনার ডাক আল্লাহ শুনেছেন এবং তিনি আপনাকে একটি বর (রহমত) দিয়েছেন, আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন। তবে একটি শর্তে, আপনি যা পাবেন আপনার প্রতিবেশী পাবে তার দ্বিগুণ। লোকটি রাজি হয়ে গেল।
সে তৎক্ষণাৎ পোলাও, কোর্মা খেতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে তা হাজির হয়ে গেল। পরক্ষণে সে দেখল তার প্রতিবেশী এর চাইতে দ্বিগুণ পেয়েছে। প্রথম প্রথম এ ব্যাপারে সে মাথা ঘামাল না। কিন্তু দিনে দিনে তার ঈর্ষা বাড়তে লাগল। মনে মনে ভাবলো আমি যা চাই, আমার প্রতিবেশী কিছু না চেয়েই তার দ্বিগুণ পেয়ে যাচ্ছে! লোকটি একসময় তার জীর্ণ কুটিরের পানে চেয়ে বলল, এরকম বাড়িতে আমাকে মানায় না, আমাকে সুন্দর একতলা বাড়ি করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে একতলা বাড়ি হয়ে গেল। লোকটি খুশি মনে বাড়ির ছাদে উঠে দেখল তার প্রতিবেশীর দোতলা বাড়ি হয়ে গেছে এবং ছাদে সে পায়চারি করছে। লোকটি ঈর্ষা এবং ক্রোধে ফেটে পড়ল; অন্যের ভালো তার বুদ্ধি—চেতনা লোপ করে দিল। সে ঈর্ষায়—হিংসায় আল্লাহর কাছে বর চাইল, ‘আমার এক চোখ কানা করে দাও’ যাতে তার প্রতিবেশীর দু’চোখ কানা হয়ে যায়।
লেখকঃ
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক
ফোনঃ ০২—৪৭১২২৪৬৩, ০২—৯৫১৫০৯৯
web: www.helal.net.bd
e-mail: m7helal@yahoo.com